বাংলাদেশিদের কম্বোডিয়ায় নিয়ে ‘সাইবার দাস’ বানিয়ে মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে বাধ্য করা হচ্ছে। মেয়েদের ভিডিও কল দিয়ে আপত্তিকর অঙ্গভঙ্গি ও কথাবার্তা রেকর্ড করা হচ্ছে। এরপর সেগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা আত্মসাতে বাধ্য করানো হচ্ছে। কেউ এমন প্রতারণার কাজ করতে না চাইলে বা টার্গেট পূরণে ব্যর্থ হলে তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে ‘মানবপাচার’ ও ‘সাইবার দাস’-এর মতো অমানবিক ঘটনা ঘটলেও বিষয়টি জানা নেই আন্তর্জাতিক কোনো এনজিও বা বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কোনো মহলের।
কম্বোডিয়া ফেরত এবং দেশটিতে বসবাসরত মোট ৩০ বাংলাদেশির সঙ্গে কথা হয় সময়ের সাথীর। কাদের মাধ্যমে তারা কম্বোডিয়ায় কাজের উদ্দেশ্যে গেছেন এবং কীভাবে বাংলাদেশি দালালদের মাধ্যমে চীনা প্রতিষ্ঠানে বিক্রি হয়েছেন— এসব বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলেন ভুক্তভোগীরা। তারা সবাই ঘুরেফিরে কয়েকজন ব্যক্তির নাম বলেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন কম্বোডিয়া প্রবাসী হায়দার খান সাগর, শফিকুল ইসলাম ওরফে ভোতা শফি, রাকিব ওরফে মশলা রাকিব, মারুফ হোসাইন, মোতাহার হোসাইন, সোহাগ ও জসিম উদ্দিন।
তারা ৭ জনই কম্বোডিয়ায় থাকেন, পেশায় ‘দালাল’। তারা বাংলাদেশ থেকে যাওয়া প্রবাসীদের বিভিন্ন ফ্ল্যাটে তুলে কম্পিউটারের ওপর প্রশিক্ষণ দেন। পরে তাদের বিক্রি করে দেন চীনা প্রতিষ্ঠানের কাছে। একজন প্রবাসীর বেশে হায়দারকে হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে ফোন করা হয়। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা প্রবাসীদের ভিসার বিষয়ে সহযোগিতা করি। ইনভাইটেশন পাঠাই, টিকেট বিক্রি করি, চাকরির ব্যবস্থা করি।
তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই ৭জন তেমন কোনো সহযোগিতা করেন না। কম্বোডিয়ার ভিসার জন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠানের প্যাডে ইনভাইটেশন পাঠাতে হয়। তারা BMFC CONSTRUCTION প্রতিষ্ঠানের নামে শুধুমাত্র সেটা পাঠান, তাও ভুয়া। ওই ভুয়া ইনভাইটেশন দেখে কম্বোডিয়ার দিল্লি বা মালয়েশিয়া দূতাবাস থেকে ইস্যু করা হয় ভিসা।

অনুসন্ধানে জাহাঙ্গীর এবং হারুন নামের আরও দুই বাংলাদেশি দালালের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তারা উভয়ই দীর্ঘদিন যাবত টুরিস্ট ভিসায় মানুষকে কম্বোডিয়া নিয়ে থাই বর্ডার হয়ে মালয়শিয়াতে পাচার করে থাকেন এবং ক্রীতদাস বিক্রির দালাল হিসেবে কম্বোডিয়াতে পরিচিত । সময়ের সাথীর সঙ্গে কথা বলা ভুক্তভোগী পাঁচ বাংলাদেশি জানান, তারা (সোহাগ, শফি ও জসিম) নম পেন বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশিদের রিসিভ করেন। এরপর গাড়িতে করে হায়দার, শফি এবং মোতাহার তাদের নিজস্ব ভারা করা ফ্ল্যাটে নিয়ে যায়।
ভূক্তভূগিরা জানান, সোহাগ, জসিম, রাকিব, মারুফ, শফি, মোতাহার প্রথমে বাংলাদেশে থাকা নিরীহ বেকার যুবকদের টার্গেট করে। পরে তাদের উচ্চ বেতনের ভালো চাকরির প্রলোভনে ফেলে কম্বোডিয়াতে পাচার করে। পাচারের বাংলাদেশি ধাপ সম্পন্ন করেন হায়দার খান সাগর, বাংলাদেশ এয়ারপোর্টে কিছু অসাধু এয়ারপোর্ট কর্মকর্তার সহযোগিতায় কম্বোডিয়াতে পাচার করে। কম্বোডিয়া এয়ারপোর্ট থেকে যার যার লোক সে রিসিভ করে নিয়ে যায় হায়দার, শফি এবং মোতাহারের ভারা করা ফ্ল্যাটে।

এরপর শুরু হয় তাদের প্রতারণার বিশেষ ট্রেনিং। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া নিরীহ যুবকদের ট্রেনিং এর দায়ত্ত হায়দার খান সাগর এর। মূলত অনলাইন ক্যাসিনো গুলোতে বিক্রির সময় চড়া দাম পাওয়ার আশায় তাদের এই ট্রেনিং কার্যক্রম। ট্রেনিং শেষে এক এক জন বাংলাদেশিকে বিক্রি করা হয় ৪ থেকে ৫ লক্ষ টাকার বিনিময়ে। জসিম, সোহাগ, মশলা রাকিব এবং মারুফ তাদের লোক বিক্রি করে জাহাঙ্গীর এবং হারুন নামের ২ জন দালালের মাধ্যমে। হায়দার, শফি এবং মোতাহার লোক বিক্রি করার মিঃ কিম নামের একজনের সাথে নিজস্ব লিংক রয়েছে। মিঃ কিম চায়নিজ মানবপাচার এবং ক্রীতদাস বিক্রি সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা। শফি কিছু লোক বিক্রি করেন গোলাম সারোয়ার আলম নূর নামের এক মানবপাচারকারীর মাধ্যমে, নূর আবার বিক্রি করেন কয়েক দফায়।

এই ৭ প্রতারকের মাধ্যমে আসা সর্বমোট ২০০ এর অধিক নিরীহ কর্মী এখনো বিভিন্ন ক্যাসিনোতে বন্ধী রয়েছে। কম্বোডিয়ান পুলিশের কানে পৌছায় না তাদের মুক্তির আর্তনার। অনেকেই ৩ থেকে ৪ লক্ষ টাকার মুক্তিপণ দিয়ে বের হয়ে কোনো রকমে প্রান বাচিয়ে চলে গেছেন বাংলাদেশে। তাদেরও প্রতিনিয়ত দেওয়া হচ্ছে প্রাণ নাশের হুমকি।
এ চক্রের সদস্য সংখ্যা ২০ থেকে ২২ জন। তাদের মধ্যে তিনজন বাংলাদেশ থেকে কর্মী সংগ্রহ করতেন। বাকিরা কম্বোডিয়া থাকেন। সম্প্রতি বাংলাদেশে অবস্থান করা তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন- র্যাব। তারা হলেন- নাজমুল ইসলাম (৩০), নূর ইসলাম সাজ্জাদ (২৫) ও মো. সিরাজুল ইসলাম পঞ্চায়েত (৫৭)। তারা কম্বোডিয়া গমনেচ্ছুদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ভিসার ব্যবস্থা এবং তাদের বিমানবন্দরে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করতেন।
পাচারকারী চক্র

হায়দার খান সাগরঃ নিজেকে এয়ারটিকেট ও মোবাইল ব্যবসায়ী পরিচয় দিলেও আদতে একজন পোক্ত মানবপাচারকারী এবং প্রতারক। ২০১৮ সালে মানবপাচারের অভিযোগে তাকে চায়নিজ সরকার চায়নাতে ব্লাকলিস্ট করে এবং ৫ বছরের কারাদন্ড দেয়, কোনো রকমে সেখান থেকে বেচে পালিয়ে টুরিস্ট ভিসায় কম্বোডিয়া চলে আসেন কিন্তু সেখানেও থেকে যান অবৈধ ভাবে। সেখানে এসে শুরু হয় তার পাপের আরেক রাজত্য। চোরাই মোবাইল বাংলাদেশে ঢোকানো এবং মানবপাচার ব্যবসায় জরিত থাকার দরুন তার বাংলাদেশ কাস্টমস এবং কিছু অসাধু এয়ারপোর্ট কর্মকর্তার সাথে পরিচয় এবং লেন-দেন ছিল। সেটা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ থেকে নিরীহ অসহায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের ইউরোপ এবং কানাডা পাঠানোর স্বপ্ন দিয়ে কম্বোডিয়াতে পাচার করতে থাকেন। ধিরে ধিরে আরো কয়েকজন সহকারী নিয়ে গড়ে তোলেন মানবপাচারকারী চক্র। এখন পর্যন্ত পাচার করে বিক্রি করছেন ১০০ এর বেশি বাংলাদেশিকে।

শফিকুল ইসলাম ওরফে ভোতা শফিঃ একসময় থাকতেন মালয়শিয়ায়, ব্যবসা ছিলো ভূয়া কলিং ভিসা বিক্রি করে মানুষকে প্রতারিত করা এবং ইন্দোনেশিয়াকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে মালয়শিয়ার মানব পাচার করা। মালয়শিয়া ইমিগ্রেশন পুলিশ ইমিগ্রেশন জালিয়াতি মামলা করলে পালিয়ে চলে আসেন কম্বোডিয়া। সেখানে এসে শুরু হয় তার মানবপাচারের আরেক রাজ্য। প্রথমে বাংলাদেশ থেকে নিরীহ মানুষকে কম্বোডিয়ায় টুরিস্ট ভিসায় এসে মোঃ কবির হোসাইন নামের একজনের মাধ্যমে থাই বর্ডার দিয়ে মালয়শিয়ায় পাচার করতেন। ২০২০ সাল থেকে জড়িয়ে যান ক্যাসিনোতে দাস বিক্রির ব্যবসায়। এর পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ইতোমধ্যে কম্বোডিয়া তে পাচার করে বিক্রি করেছেন ১৫০ এর বেশি বাংলাদেশিকে।

মোতাহের হোসেনঃ মোতাহের শুরুতে বাংলাদেশি নারীদের চায়নাতে পাচার করতেন চায়নিজদের স্ত্রী হিসেবে পাসপোর্ট বানিয়ে। একবার ধরা পরার পর চলে যান ফিলিপাইনে। সেখানে থাকাকালীন অবস্থায় সেখান থেকে অস্ট্রেলিয়ায় মানবপাচার করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হন এবং ফিলিপাইন ইমিগ্রেশন কন্ট্রোল ডিপার্মেন্ট তার নামে মামলা দায়ের করেন। সেখান থেকে পালিয়ে আসেন কম্বোডিয়া। সেখানে এসে নিজে বিক্রি হয়ে যান এক ক্যাসিনো। ৬ মাস সেখানে চাকরি করার অবস্থায় ৩য় মাসে তিনি জানতে পারেন, এখানে তাকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে বের হয়ে তিনি নিজে শুরু করেন বাংলাদেশ থেকে মানবপাচার করে কম্বোডিয়াতে বিক্রি করা। তিনি ইতো মধ্যে ১০০ ও বেশি বাংলাদেশিকে পাচার করে বিক্রি করেছেন।


রাকিব ওরফে মশলা রাকিব এবং মারুফঃ রাকিব সাউথ আফ্রিকা থেকে আসার মুকুল (প্রতারক এবং মানবপাচারকারী) নামের একজনের জানতে পারেন কম্বোডিয়া থেকে খুব সহজেই মানবপাচার করা যায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। চলে এসেন কম্বোডিয়া, শুরু করেন কম্বোডিয়া হয়ে মালয়শিয়ায় মানবপাচার। নিজের মার্কেটিং এর জন্য পাশাপাশি শুরু করেন মানিলন্ডারিং তথা হুন্ড্রি ব্যবসা। সাধারণ কন্সট্রানশন শ্রমিকদের সাথে সহজেই গড়ে উঠে সখ্যতা। এরপর কম্বোডিয়াতে নিয়ে আসেন ছোট ভাই মারুফকে যিনি ধিরে ধিরে রাকিবের থেকেও মারাত্তক হয়ে। নাইটক্লাবে মারুফের পরিচয় হয় বার-গার্ল নানি (৩০) নামের একজন কম্বোডিয়ান বার কর্মীর সাথে, এই বার-কর্মী নানি (৩০) হয়ে ওঠে তাদের ২ ভাই এর প্রধান হাতিয়ার। হুন্ড্রির নাম করে অসংখ্য বাংলাদেশি শ্রমিকের টাকা আত্নস্বাদ করে তারা ২ ভাই। টাকা চাইতে আসলে বার-গার্ল নানি তাদের ধর্ষন মামলার ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেন। অসংখ্য মানুষকে ভিসা এক্সটেনশনের নাম করে অবৈধ করে তাদের টাকা আত্নস্বাদ আতবসাদ করেছে। এর পর শুরু হয় তাদের মানবপাচার। জাহাঙ্গীর, হারুন, লায়ন কামাল এবং আতিকের সহায়তায় এখন পর্যন্ত ১০০ এর বেশি বাংলাদেশি কে কম্বোডিয়ায় পাচার করে বিক্রি করেছেন এই ২ ভাই।


সোহাগ–জসিমঃ সোহাগ এবং জসিম হায়দার, মোতাহার, শফি গ্রুপের সদস্য। তারা বাংলাদেশ থেকে লোক এর জোগান দিয়ে থাকে। জসিম এর বোনের জামাই আব্দুর রহমান ২০২০ সালে কম্বোডিয়াতে মানবপাচারের দায়ে ব্ল্যাকলিস্ট হয়ে বর্তমানে দুবাইতে অবস্থান করছে। সোহাগ এবং জসিম মূলত হায়দার, মোতাহার ও শফির মাধ্যমে নিরীহ যুবকদের কম্বোডিয়াতে পাচার করে বিক্রি করে। কম্বোডিয়ার অবস্থানরত সাধারণ কন্সট্রাকশন কর্মীদের প্রলোভন দেখি তাদের কাছ থেকে তাদের আত্মীয়-সজন এর পাসপোর্ট নিয়ে জাল ভিসা দিয়ে প্রতারিত করে, হায়দার কম্পিউটার এক্সপার্ট হওয়ার সুবাদে জাল ভিসা বানানোর কাজ হায়দার সম্পন্ন করে।
প্রতারিতরা অভিযোগ নিয়ে আসলে তাদের গায়ের জোরে প্রতিহত করে জসিম-সোহাগ এবং হায়দার, মোতাহার, শফি গ্রুপ। ভূক্তভূগিদের মধ্যে অনেকেই দেশে যেতে পারছে না দেনার দায়ে। এখন পর্যন্ত গোহাগ ও জসিম ১৫০ এরও বেশি বাংলাদেশিকে কম্বোডিয়ায় পাচার করে বিক্রি করেছে। তাদের বিক্রিত ২জন ভূক্তভূগি এখনো শিহানকভিল একটি ক্যাসিনো তে বন্ধী, যাদের লিখিত অভিযোগ আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। যারা ইতোমধ্যে বাংলাদেশে মামলা দায়ের করেছে এবং কম্বোডিয়াতে মামলা করার প্রস্ততি চলছে।